জীবনের চালচিত্র
-সুমিতা দাশগুপ্ত
তরুণ ফল বিক্রেতা ফটিক, ঠেলাগাড়িতে করে ফল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করে বেড়ায়। বেলা এখন প্রায় সাড়ে দশটা। নানান এলাকা ঘুরে, অবশেষে এই শুনশান পাড়াটিতে ঠেলা নিয়ে ঢুকে পড়লো সে। এদিককার ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে অনেক বাঁধা খদ্দের আছে তার।
এই এলাকায় বেশ কিছু সম্পন্ন মানুষের বসবাস। ফটিক সঠিক ওজনে, ন্যায্য দামে, টাটকা ফল বেচে বলে অনেকেই বাজার থেকে না কিনে তার অপেক্ষাতেই বসে থাকেন। তাই ফটিক রোজ একবার করে এই পাড়াটা ঘুরেই যায়।
আজও এই পাড়ায় ঢুকতেই সাদা রঙের ফ্ল্যাটবাড়িটার দিকে নজর চলে গেল। তিনতলার বারান্দা থেকে হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছেন বোসবাবু। তিনি একজন শাঁসালো খদ্দের, দু’ তিন দিন অন্তর বিস্তর ফল কিনে থাকেন। ফটিক খুব খুশি হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।
তিনতলা থেকে নীচে নেমে এসে নেড়েচেড়ে ফলগুলো বাছাই করে রাখছিলেন বোসবাবু। তরমুজ, সবেদা, কলা, পেয়ারা বেছে বেছে একপাশে রেখেছেন, আর কী নেওয়া যায় ভাবছিলেন তিনি। ওপাশের বটতলায় খেলা করা দুটি বাচ্চা, খেলা ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
-“ও দাদু ঐ যে দেখো দেখো ওপাশে কতো আঙুর- সবুজ, কালো নেবে না?”
-“আঙুর? কোথায় আঙুর? ওহ্ ঐ যে, হ্যাঁ হ্যাঁ, পাঁচশো আঙুরও দিয়ে দে তো” তারপর হঠাৎই খেয়াল পড়তেই বাচ্চাদুটিকে খেঁকিয়ে উঠলেন,”এ্যাই তোরা এখানে কী করছিস রে? ভাগ্ এখান থেকে।”
শিশুদুটি একটু সরে দাঁড়ালো কিন্তু চলে গেল না।
ফটিক সবুজ রঙের আঙুর ওজন করছে, অপেক্ষাকৃত ছোট বাচ্চাটি বলে উঠলো, “ও দাদু ঐ কালোগুলো নাও না, কী সুন্দর দেখতে!”
না, তারা নিজেরা খাওয়ার কথা ভাবছিল না, তাদের ইচ্ছেটুকু মর্যাদা পাচ্ছে, এইটুকু দেখলেই তারা খুশি, এটাও বুঝি তাদের খেলারই অঙ্গ!
বোসবাবু আবার খেঁকিয়ে ওঠার আগেই ফটিক ছোট এক থোলা কালো আঙুর তাদের হাতে তুলে দিতেই, অবাক বিস্ময়ে উৎফুল্ল বাচ্চাদুটি এক ছুট লাগালো ওই বটতলার পানে।
ফটিক এবার মুখে মুখে হিসেব কষছে, শেষটায় সাড়ে পাঁচশো আঙুরের দাম ধরতেই, বোসবাবু রেগে উঠে বললেন, “এ্যাই দাঁড়া দাঁড়া, এতকাল ধরে ফল নিচ্ছি তোর কাছে, এখন আবার ঠকাতে শুরু করে দিলি!”
-“কী ঠকালাম বাবু?”
ওই বাচ্চাগুলোকে যে আঙুরের থোকাটা দিলি, তার দামটাও এখান থেকেই আদায় করছিস না রে? চাইলাম পাঁচশো আঙুর, দাম নিচ্ছিস সাড়ে পাঁচশোর?”
মৃদু হেসে ফটিক আঙুরগুচ্ছ আবার পাল্লায় চাপিয়ে সঠিক ওজন বোসবাবুকে দেখিয়ে দিল। ইলেকট্রনিক ওজন যন্ত্র বরং ওপাশেই একটু ঝুঁকে আছে। বোসবাবুকে আশ্বস্ত করে ফটিক হেসে বললে, “খদ্দের ঠকানোর ব্যবসা আমি করি না বাবু। ওটুকু আমিই ওদের ভালোবেসে খেতে দিলাম।”
বোসবাবু এবারে আশ্বস্ত হয়ে দাম মিটিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ পিছন ফিরে বললেন, “এভাবে চললে তোর ব্যবসা তো লাটে উঠবে রে।”
ফটিক হেসে বললে, “ওটুকু ক্ষতি আমার পুষিয়ে যাবে বাবু, ওদের হাসিমুখের দামে।”
আজীবন পাইপয়সার হিসেব কষা বোসবাবুর ভ্রু’টা অবশ্য কোঁচকানোই রয়ে গেল! এইসব আবেগকে প্রশ্রয় দিলে ব্যবসা করে আর খেতে হয় না!
আদ্যোপান্ত ঘটনাটির সাক্ষী, দোতলার বারান্দায় বসা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মুখে একটুকরো হাসি খেলা করে গেল। নিজের মনেই মৃদুস্বরে আবৃত্তি করলেন –
” যে ধনে হইয়া ধনী
মণিরে মানো না মণি
তাহারি খানিক মাগি আমি নতশিরে।”
এমনই কতোশতো টুকরো টাকরা মুহূর্ত দিয়ে তৈরি হয় আমাদের জীবনের চালচিত্র, কখনও খেয়াল করি, আবার কখনও বা আনমনে ভেসে যায়, কালের স্রোতে, হারিয়ে যায় কালের গর্ভে।
This is a amazing writeup
True assessment of the pathos of life.Apprecite the presentation page.
ধন্যবাদ ❤️
গল্প পড়ে ২ মিনিট চুপ করেই রইলাম । লেখা এমন অনুভূতি-জাগানিয়া হলেই বড়ো আনন্দ হয় । ভালো থাকবেন ।